গল্প- সম্পর্কের টানাপোড়ন

সম্পর্কের টানাপোড়ন
-রেহানা দেবনাথ

 

অনিমা আর রাতুল সব বয়সী বন্ধু একই বস্তিতে থাকে। তার জন্য ছোট্ট থেকেই খুব সহজে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণী থেকে রাতুলের দুপুরে স্কুল হয়ে যায়। তবুও তাদের বন্ধুত্বের ঘাটতি দেখা যায় না।
শৈশবে তাদের বন্ধুত্ব সকলে মেনে নিলেও কিশোর বয়সের বন্ধুত্ব নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়ে যায়।
প্রতিবেশী,বন্ধু বান্ধব,আত্মীয় স্বজনেরা সবাই তাদের মেলামেশাকে প্রেমের রূপ দেয়। তারা অস্বীকার করে ভালো বন্ধু বলে।
রাতুলের বাবা মায়ের একটাই কথা এই বস্তির মেয়ের সঙ্গে আমাদের একমাত্র ছেলের বিয়ে দেব না। গ্রামে আমাদের বিশাল সম্পত্তি ও নাম আছে। আর ওই হাড় হাভাতে অনিমাকে তো বউ হিসেবে কোনোদিনই মেনে নেব না।
এই কথা লোকের মুখে মুখে অনিমার মায়ের কানেও পৌঁছে যায়। দুই পরিবারের মধ্যে বিশাল গণ্ডগোল হয়। তাতেও দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট থাকে।

সময় পেরিয়ে যায় যুবতী অনিমার বিয়ে ঠিক হয় তখন দু’জনে উপলব্ধি করে দু’জনে দু’জনকে ছাড়া থাকতে পারবে না। ফলস্বরূপ বিয়ে ভেস্তে যায়।

অনিমার কপালে বাড়ির লোকের অত্যাচার আর প্রতিবেশীদের তিরস্কার জুটল।

রাতুলের মা বাবা প্রথমে কিছু বলে নি। দু’দিন পর দাদু অসুস্থ এই অজুহাতে তাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায় ।
রাতুলের মা আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে তার বিয়ে গ্রামের এক মেয়ের সঙ্গে দিয়ে দেয়।

মাস খানেক হয়ে গেলে যখন রাতুলের পরিবার ফিরে আসে কিন্তু রাতুল ফেরে না তখন অনিমা ওর বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলে ওরা অপমান করে তাড়িয়ে দেয়!

অনিমা রাতুলের খোঁজ না পেয়ে পাগলের মত হয়ে যায় !
এরপর সত্যি খবর এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় যে রাতুলের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের ছবিও সবাই দেখেছে, এমনকি অনিমাও দেখে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না!
অনিমা কি করবে বুঝতে পারে না। নিজেকে ঘরবন্দি করে নেয়,ৎরাগে দুঃখে পাথর হয়ে যায়।

এইভাবে একটা বছর পার হয়ে যায়………….
হঠাৎ একদিন একটি ছেলে এসে অনিমাকে চিরকুট দিয়ে যায়। তাতে রাতুল দেখা করার জায়গা ও সময় লিখে দিয়েছে।
এতদিন পর রাতুলের চিঠি পেয়ে নিস্তেজ অনিমা অনেকটা সতেজ হয়ে ওঠে।
তারপর নিদির্ষ্ট সময়মতো অনিমা রাতুলের সঙ্গে দেখা করে।
শীর্ণ শরীর দু’চোখের তলায় কালি পড়া অনিমাকে দেখেই রাতুল জড়িয়ে ধরে বলে একি চেহারা বানিয়েছিস! অনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলে তোকে ছাড়া বেঁচে আছি সেটাই আশ্চর্য্যের ব্যাপার! আমি জানতাম তুই একদিন ফিরে আসবি তাই মরি নি!
এরপর রাতুল সমস্ত ঘটনা জানায়। তারসঙ্গে এও জানায় যে বিয়ে সে মায়ের চাপে করলেও ছয় মাসের মাথায় সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ বউয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তৈরি করে নি সেই কারণে অশান্তি শুরু হয়। আজও রাতুল শুধু অনিমাকে ভালোবাসে তাই কাজ খুঁজে আয় করে ভাড়ার ঘর ও তাতে সংসারের সমস্ত জিনিস কিনে সাজিয়েছে। আজ সে অনিমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।
অনিমা রাতুলকে ফেরাতে পারে না তাই তার সাথে চলে যায়।
নতুন সংসার পাতলো দু’জনে। ভালো ভাবেই দিন কাটছিল।
এরপর একদিন খোঁজ পেয়ে রাতুলের মা হাজির হয়। বাবা অসুস্থ রাতুলকে দেখতে যেতে বলে কিন্তু অনিমার যাওয়া বারণ!

প্রথম প্রথম রাতুল বাবাকে দেখতে গেলে সেই দিনই চলে আসতো কিন্তু পরে পরে দু’ একদিন পরে ফিরত!
এরপর রাতুলের বাবা মারা গেলে,রাতুল মায়ের কাছে গিয়ে দু’ তিনদিন করে সপ্তাহে কাটিয়ে আসতে লাগলো।

অনিমার মা অসুস্থ তাকে দেখতে যায় অনিমা। সেখানে গিয়ে জানতে পারে রাতুলের আগের বউকে ওর মা এখানে এনে রেখেছে!

অনিমার রাতুলের উপর থেকে বিশ্বাস কমতে থাকে কারণ যখনই ও রাতুলকে আগের বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করে বলে বাপের বাড়ি চলে গেছে।

ওদিকে রাতুলের মা বৌমা শিমুলকে শেখাতে থাকে কিভাবে অন্য মেয়ের কাছ থেকে নিজের স্বামীকে ঘরে ফেরাতে হয় ।

শিমুল গ্রামের সাধাসিধে মেয়ে স্বামীকে দেবতা মনে করে তাই সবরকম চেষ্টা চালাতে থাকে। এই কাজে সাহায্য করার জন্য রাতুলকে ওর মা বিভিন্ন অজুহাতে দু’দিন ছাড়া ডেকে নিত আর সহজে যেতে দিত না।রাতুল আর অনিমার সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে!রাতুল অনিমা, মা ও শিমুলের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়নে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মদ খেতে শুরু করে!অনিমা রাতুলকে তার প্ৰথম বউকে ডিভোর্স দেবার কথা বললে সে জানায় মা অসুস্থ এখন এইসব কথা বলা যাবে না।

এইভাবে আরো একটি বছর কেটে যাবার পর একদিন অনিমা বাপের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে রাতুলের মা সবাইকে বলছে তার বৌমা গর্ভবতী।অনিমা বাড়ি ফিরে রাতুলের সঙ্গে ঝগড়া করলে রাতুল জানায় জ্ঞানত অবস্থায় তার সঙ্গে শিমুলের কোনো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয় নি। কিন্তু মনে মনে ভীত হয়ে পড়ে কারণ ওই বাড়িতে থাকলে মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে দেখেছে তার পাশে শিমুলকে শুয়ে থাকতে!
একদিন অনিমা ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারে মা হওয়ার জন্য তার সব মেডিকেল রিপোর্ট ওকে। তারপর জোর করে রাতুলকে নিয়ে গিয়ে চেকআপ করায়। রাতুলের স্পার্ম কাউন্ট রিপোর্টে দশ হাজারের নীচে আছে, যার কারণে সে কোনোদিন বাবা হতে পারবে না বলে ডাক্তারবাবু জানিয়ে দেন।অনিমা রাতুলকে কিছু জানায় না। লুকিয়ে চোখের জল ফেলে।
এদিকে একজন আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হলে জানতে পারে রাতুলের মা সবাইকে বলেছে রাতুল প্রথম বউকেই ভালোবাসে তাই তার বাচ্ছা হবে আর ওকে রক্ষিতা করে রেখেছে।
অনিমার মাথা গরম হয়ে যায়। সে সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে শ্বশুর বাড়ী উপস্থিত হয়।চেঁচামেচিতে অনেক লোকজন রাতুলদের বাড়িতে জমা হয়ে যায় তখন অনিমা রাতুলের সমস্ত রিপোর্ট সবাইকে দেখিয়ে দেয়।

প্রতিবেশীরা সবাই অবাক হয়ে যায়।সবার তির্যক প্রশ্নে শিমুল হতভম্ব হয়ে যায়। গর্ভবতী হওয়া নিয়ে তাকে সবাই চরিত্রহীন বলতে থাকে! তখন রাতুলের মা বলে যে শিমুল গর্ভবতী নয়, এমনি তিনি বলেছিলেন। শিমুল লজ্জায় দুঃখে সেদিনই বাপের বাড়ি চলে যায়।

রাতুল সমস্ত কথা জানার পর অনিমার সঙ্গে ঝগড়া করে এমনকি গায়ে হাত তোলে! তুই আমার মান সম্মানের কথা ভাবলি না সমাজের কাছে আমাকে নপুংসক প্রমাণ করলি।অনিমা জানায় ও মা হতে পারুক আর না পারুক সরাজীবন এইভাবেই রাতুলকে ভালোবেসে যাবে।

রাতুল কিন্তু সহজে তা মেনে নিতে পারে না।নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে। মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকে। মদ খাওয়া বেড়ে যায়। কাজ ছেড়ে দেয়।
ওদিকে রাতুলের মাও ছেলের শোকে বিছানা নেয়।

কিছুদিন পর রাতুল নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।অনিমা তখন সব ছেড়ে অসুস্থ শাশুড়ির কাছে চলে যায়। লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করে নিজের ও অসুস্থ শাশুড়ির খরচ চালায়। সেই সঙ্গে রাতুলের খোঁজও চালায়।

এইভাবে পাঁচটি বছর কেটে যায় ….
রাতুল আবার ফিরে আসে। এবারে আর অনিমা তাকে মেনে নিতে পারে না!
রাতুলের প্রতি অভিমান রাগ এতটা জমাট বেঁধে গিয়েছিল যে অনিমার হৃদয়ে বন্ধুত্ব ভালোবাসা কোনো কিছুই আর রাতুলের প্রতি তার আগের অনুভূতিগুলোকে ফেরৎ আনতে পারলো না!!

রাতুলের মা সুস্থ হয়ে যাবার পর ছেলেকে পেয়ে অনিমাকে অপমান করতে থাকে।ছেলেকে জানায় এতদিন ধরে তার উপর অনিমা অত্যাচার করত, খেতে দিত না ইত্যাদি ইত্যাদি…
সেই শুনে রাতুল আবার অনিমাকে যা নয় তাই বলতে থাকে….

দুঃখে কষ্টে অনিমা সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরে ওই এলাকায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে আর দিনরাত কাজ করতে থাকে। সেই সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশীদের দায় বিপদে ছুটে বেড়ায়।স্বার্থহীন ভাবে মানুষের উপকার করতে থাকে।

সব ভুল ভেঙে গেলে রাতুল অনেকবার অনিমার কাছে ক্ষমা চায়। স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে চায়।

অনিমা কিন্তু তাকে মন থেকে আর মেনে নিতে পারে না।

রাতুল আর অনিমার সম্পর্ক এখন অতিথির মত। সেখানে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা মৃত!!
রাতুল বছরে দু’এক বার অনিমার কাছে আসে কয়েকদিন কাটিয়ে আবার চলে যায় গ্রামের বাড়িতে।
অনিমা মন থেকে না হলেও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল………সমাজের কথা….নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে!!

Loading

Leave A Comment